রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৪০ অপরাহ্ন
ভয়েস নিউজ ডেস্ক:
ঈদের আগে সারাদেশে সব ধরণের পোশাকের দোকানগুলো বন্ধ থাকায় দেশীয় ফ্যাশন হাউজ এবং তৈরি পোশাক বিক্রি করা দোকানগুলো বড় ধরণের ক্ষতির মুখে পড়বে
করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে বাংলাদেশে চলমান ছুটির কারণে গত প্রায় দেড় মাস যাবত বন্ধ রয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া আর সব ধরণের দোকানপাট। যার মধ্যে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে সব ধরণের পোশাকের দোকান।
আর রোজার ঈদের আগে সারাদেশে সব ধরণের পোশাকের দোকানগুলো বন্ধ থাকায় দেশীয় ফ্যাশন হাউজ এবং তৈরি পোশাক বিক্রি করা দোকানগুলো বড় ধরণের ক্ষতির মুখে পড়বে।
সারা দেশে সব ধরণের শপিং মল, বাজার এবং দোকানপাট বন্ধ থাকায় কিছু ফ্যাশন হাউজ এবং দোকান ক্রেতাদের কাছে অনলাইনে পণ্য বিক্রি করা শুরু করলেও তার পরিধি চাহিদার তুলনায় অত্যন্ত কম বলে মন্তব্য করছেন সংশ্লিষ্টরা।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে ২৬শে মার্চ থেকে বাংলাদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। এরপর ছয় দফা বাড়িয়ে ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হয় ১৪ই মে পর্যন্ত। আর এই সময় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও ওষুধের দোকান ছাড়া সব ধরণের দোকান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
পোশাকের দোকান বন্ধ থাকার ফলে পহেলা বৈশাখে (১৪ই এপ্রিল) পণ্য বিক্রি করতে পারেনি ফ্যাশন হাউজগুলো, যার ফলে ঐ দফায় বড় অঙ্কের ক্ষতির সম্মুখীন হয় তারা। এবার রোজার ঈদের আগে দিয়ে সেসব ফ্যাশন হাউজ এবং পোশাকের দোকানগুলোর কার্যক্রম শুরু না হলে দেশীয় পোশাক শিল্পের সাথে জড়িত লাখ লাখ মানুষের জীবন তো বটেই, পুরো শিল্পই হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংকটে দেশের লক্ষাধিক পোশাকের দোকান
ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে একটি তৈরি পোশাকের দোকান রয়েছে জাবেদ আক্তারের। তিনি দোকানে মূলত নারীদের পোশাকই বিক্রি করে থাকেন।
জাবেদ আক্তার বলেন বছরের দশ-এগারো মাস ব্যবসায় ক্ষতি হলেও রমজান মাসে সারাবছরের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার সুযোগ থাকে তাদের কাছে, যেটি এই বছর হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
“ঈদকে সামনে রেখে ঋণ করে কিছু টাকা অগ্রীম দিয়ে নানা ধরণের পণ্য তুলেছি দোকানে। ঈদে বিক্রির টাকা পাওয়ার পর সেই টাকা পরিশোধ করার কথা। কিন্তু দোকান বন্ধ থাকার কারণে বিক্রি না হওয়ায় ঋণও শোধ করতে পারবো না, পণ্যের দামও দিতে পারবো না।”আর এই ক্ষতির রেশ আগামী অন্তত এক বছর ধরে তাকে টানতে হবে বলে আশঙ্কা করছেন জাবেদ আক্তার।
জাবেদ আক্তারের মত হাজার হাজার দোকান মালিক এই সমস্যায় পড়বে বলে মনে করেন আসাদ ইফতেখার নামে এক দোকান মালিক, যিনি চট্টগ্রামের দুইটি শপিং মলের দোকান মালিক সমিতির সভাপতি।
আসাদ ইফতেখার বলেন, “বৈশাখ এবং ঈদকে মাথায় রেখে অধিকাংশ দোকান পাঁচ ছয় মাস আগে থেকেই বিভিন্ন পণ্য কিনেছে এবং অর্ডার দিয়েছে। এসব পণ্য কেনার ক্ষেত্রে দোকানদাররা সাধারণত ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন মেয়াদে ঋণ করে, তারপর ক্রেতাদের আংশিক মূল্য পরিশোধ করে পণ্য কেনে এবং উৎসবের সময় তা বিক্রি করে পরে ঋণ এবং মূল্য পরিশোধ করে থাকে।”
কিন্তু ঈদের সময় যেই পরিমাণ বিক্রি হওয়ার কথা, এবছর তা না হওয়ায় দোকানদাররা অর্থ পরিশোধ করতে পারবেন না, যার প্রভাব পড়বে ঈদ পরবর্তী ব্যবসায়িক কার্যক্রমে।
“অনেক দোকানদারই ঈদের জন্য তৈরি করা পণ্য – যেমন চামড়াজাত পণ্য – নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে পরে বিক্রি করতে পারবে না। আবার অনেক পোশাকও ঈদের পরে বিক্রি হবে না।”
“এই দোকানদারদের অনেকে তাদের পুরনো ঋণ শোধ না করে নতুন ঋণ নিতে সমস্যায় পড়বে। ফলে ঈদের পরে নতুন করে কার্যক্রম চালাতে পারবে না তারা। এর প্রভাবে ছোট আকারের অনেক দোকানদারই দীর্ঘমেয়াদে ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারবে না বলে আশঙ্কা করছি আমরা।”
আবার দোকানদাররা যেখান থেকে কাঁচামাল কেনে, সেসব প্রতিষ্ঠানের মূল্য পরিশোধ করতে না পারার কারণে দীর্ঘমেয়াদে সেসব প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলোর ব্যবসায় টিকে থাকতে সমস্যা হতে পারে বলে মন্তব্য করেন আসাদ ইফতেখার।
ঝুঁকিতে ক্ষুদ্রশিল্পের সাথে জড়িতরা
দোকানপাট বন্ধ থাকায় তৈরি পোশাক বিক্রি করা দোকান মালিকদের পাশাপাশি বিপদে পড়েছেন ফ্যাশন শিল্প খাতের বড়-ছোট উদ্যোক্তারাও।
দেশি উদ্যোক্তাদের সবাই গত প্রায় দেড় মাস ধরে তাদের বিক্রয় কেন্দ্র বন্ধ রাখায় এই উদ্যোক্তাদের সাথে কাজ করা ক্ষুদ্রশিল্প, কুটির শিল্প ও দেশজ বুননশিল্পের সাথে জড়িত লক্ষাধিক শ্রমিক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
বাংলাদেশের ফ্যাশনশিল্পের উদ্যোক্তাদের সংগঠন ফ্যাশন অন্ট্রাপ্রনার্স অব বাংলাদেশের সভাপতি শাহীন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে জানান তাদের আনুমানিক হিসেব অনুযায়ী সারা দেশে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া শ্রমিকদের এই সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখের কাছাকাছি।
শাহীন আহমেদও আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে ফ্যাশন হাউজগুলোর সাথে কাজ করা শ্রমিকদের অনেকেই এই খাত থেকে সরে গিয়ে অন্য খাতে কাজ করতে বাধ্য হতে পারেন।
“বড় ফ্যাশন হাউজগুলো যখন তাদের জন্য পণ্য তৈরি করা তাঁতী বা শ্রমিককে পুরো মূল্য পরিশোধ করতে পারবে না, তখন তাদের কাজও থমকে যাবে। কারণ অধিকাংশ সময় তারাও মাঝারি বা ক্ষুদ্র পরিসরে প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ নিয়ে বড় হাউজগুলোর জন্য পণ্য তৈরি করে।”
“সেই শ্রমিকরা যখন তাদের ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না, তাদের অনেকেই অন্য খাতে কাজ করে ঋণ শোধ করতে চাইবে। ফলে তারা কাজ পরিবর্তন করে অন্য খাতে শ্রম দেবে, যা পণ্যের গুণগত মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে,” বলেন শাহীন আহমেদ।
তবে এই নেতিবাচক প্রভাব যেন দীর্ঘমেয়াদে স্থায়ী না হয়, তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সাথে এরই মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে বলে জানান মি. আহমেদ।
শাহীন আহমেদ জানান, সারাদেশে প্রায় পাঁচ হাজার ফ্যাশন হাউজ তাদের সংগঠনের সাথে যুক্ত রয়েছেন। এবছর রোজার ঈদে সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা মূল্যের পণ্য বিক্রি হবে বলে ধারণা ছিল তাদের।
ঈদের এই অনুমিত বিক্রির প্রায় পুরোটাই ক্ষতি হবে বলে আশঙ্কা করছে উদ্যোক্তাদের সংস্থাটি।
তবে বর্তমানে আর্থিক ক্ষতির চেয়ে দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক প্রভাব এই খাতের বেশি ক্ষতি করবে বলে মনে করেন সংস্থার সভাপতি শাহীন আহমেদ।
“শিল্পের সাথে জড়িত সব পক্ষকে সীমিত আকারে হলেও আর্থিকভাবে সমর্থন করে যেতে হবে। এর ফলে হয়তো সবাই কম বেশি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে, কিন্তু এতে অন্তত সবাই বাজারে টিকে থাকতে সক্ষম হবে।”
বিকল্প হিসেবে কতটা কার্যকর ভূমিকা পালন করছে অনলাইন বাজার?
বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরে ই-কমার্সের জনপ্রিয়তা বাড়ার কারণে অনেক দোকানই অনলাইনে পণ্য প্রদর্শন এবং বিক্রির উপর জোর দিয়েছে।
পোশাক শিল্প খাতের এমন অনেক উদ্যোক্তাই আছেন যাদের কোনো নির্দিষ্ট দোকান বা কারখানা না থাকলেও অনলাইনে বা ফেসবুকের মাধ্যমে পণ্য প্রদর্শন করে বিক্রি করে থাকেন।
তবে এই সাধারণ ছুটির সময় অনলাইন ভিত্তিক ব্যবসায়ীরাও কার্যক্রম চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন।
গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে তৈরি পোশাক ও অলঙ্কার তৈরি করা একটি ঢাকা ভিত্তিক ফ্যাশন ব্র্যান্ডের কর্ণধার তাসমিনা নিশাত বলছিলেন, গত কিছুদিন ধরে অনলাইনে অনেক গ্রাহক তাদের পণ্য কিনতে চাইলেও কার্যত ‘লকডাউন’ চলতে থাকায় পণ্য পরিবহণ ও সরবরাহের মধ্যে সমন্বয়টা করে উঠতে পারছেন না তারা।
তাসমিনা নিশাত বলেন, “আমাদের কাজ হয় সাভারে কারখানায় এবং মানিকগঞ্জের তাঁতীদের সাথে। অনলাইনে যদিও অনেকেই আমাদের কাছে পণ্য কিনতে চাইছে, কিন্তু ‘লকডাউনে’ পোশাক পরিবহণে সরকারের অনুমতি না থাকায় সেসব জায়গা থেকে ঢাকায় পণ্য আনাতে পারছি না আমরা।”
তবে ঈদের আগে লকডাউন কিছুটা শিথিল হলে তারা স্বল্প পরিমাণে হলেও গ্রাহকদের কাছে পণ্য সরবরাহ করতে সক্ষম হবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তাসমিনা নিশাত।
তাসমিনা নিশাতের মত অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা, যাদের অনলাইনে পণ্য বিক্রি করার সক্ষমতা এবং গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, বর্তমানে রয়েছেন এমন সমস্যায়।
ঢাকার আরেকটি ফ্যাশন হাউজের কর্ণধার লিপি খন্দকারও একই সমস্যার কথা জানান। তিনি বলেন তার প্রতিষ্ঠানের ফেসবুক পেইজে অনেকেই পণ্য অর্ডার করছেন।
বিভিন্ন ধরণের পণ্যের জন্য অনলাইনে তাদের অর্ডার আসছে অনেক, কিন্তু সেগুলো ক্রেতাদের কাছ পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার কাজটা করতে নানাবিধ ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে তাদের।
আবার লকডাউনে দোকান বন্ধ থাকায় ঈদের আগে পণ্য বিক্রির লক্ষ্যে কিছু কিছু দোকানের মালিক তড়িঘড়ি করে ফেসবুকে পেইজ খুলে বিক্রির চেষ্টাও করছেন। তবে অনলাইনে পণ্য বিক্রির অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে তারাও খুব একটা সুবিধা করতে পারছেন না।
দেশের ফ্যাশন হাউজগুলোর সাথে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের জীবিকা জড়িত রয়েছে
ঢাকার গুলিস্তানের এক দোকানদার আসিফ ইমরান তার দোকানের পণ্য বিক্রির উদ্দেশ্যে কয়েকদিন আগে ফেসবুক পেইজ খুললেও এখনো ক্রেতাদের কোনো সাড়া পাননি বলে হতাশা প্রকাশ করেন।
“আমাদের মার্কেটের অনেক দোকানের মালিকই ফেসবুকে পেইজ খুলে, কাপড়ের ছবি তুলে মার্কেটিং করে বিক্রির চেষ্টা করছে। সাড়া যে একেবারে আসে না, তা নয়। কিন্তু দোকান খোলা থাকলে যেই বিক্রি হতো, তার ১০ ভাগ বিক্রিও অনলাইনে হয় না।”
ছোট বা মাঝারি ফ্যাশন হাউজগুলো অনলাইনে কেনাবেচা চালাতে নানাবিধ সমস্যার মধ্যে পড়লেও বড় হাউজগুলো ততটা সমস্যার মধ্যে পড়ছে না।
ফ্যাশন ব্র্যান্ড আড়ংয়ের প্রধান অপারেটিং অফিসার মোহাম্মদ আশরাফুল আলম জানান গত কিছুদিনে তাদের অনলাইনে অর্ডার পাওয়ার হার বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
“গত বছরের ঈদের সাথে তুলনা করলে এবছরের ঈদে অনলাইনে অর্ডারের হার অনেক বেশি। আমরা এরই মধ্যে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের সাথে কথা বলেছি এবং আমাদের পার্টনারদের সাথে আলোচনা করেছি যেন আমাদের নিজস্ব ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমের সাহায্যে গ্রাহকদের সহজে সেবা দেয়া সম্ভব হয়,” বলেন আশরাফুল আলম।
এবারের ঈদে আড়ংয়ের অনুমিত বিক্রি ছিল ৪০০ কোটি টাকা, যার শতকরা ২০ ভাগও অর্জন করা যাবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন আশরাফুল আলম।
উদ্যোক্তাদের সংগঠনের সভাপতি শাহীন আহমেদ জানান তাদের সংগঠনের সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলো যেন নিজেদের পণ্য একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে প্রদর্শন ও বিক্রি করতে পারেন, সেই সুবিধা প্রস্তুত করতে কাজ করছেন তারা।
তবে এই ঈদের আগে সেই ধরণের কোনো সুবিধা প্রস্তুত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জানান শাহীন আহমেদ। সূত্র:বিবিসি বাংলা, ঢাকা।
ভয়েস/জেইউ।